১৪২. ইন্দ্রাদি দেবগণের সহিত অর্জ্জুনের যুদ্ধ ও ময়দানবাদির পরিত্রাণ লাভ অতি ক্রোধে পুরন্দর, চড়ে ঐরাবতোপর, বজ্র করে, ছত্র শোভে শিরে। কোপেতে সহস্র আঁখি, লোহিতবরণ দেখি, আজ্ঞা দিল যত অনুচরে।। যত আছে দেবগণ, লয়ে নিজ প্রহরণ, আইসহ আমার পশ্চাতে। শুনিবারে উপহাস, তিলেক না করে ত্রাস, মম বন পোড়ায় কি মতে।। সহায় জনের সহ, বিনাশিব হব্যবাহ, এত বলি চলে বজ্রপাণি। সহ পরিবার যত, উচ্চৈঃশ্রবা ঐরাবত, চারি মেঘ চৌষট্টি মেঘিনী।। যক্ষারূঢ় মহামতি, চলিল ধনের পতি, ভয়ঙ্কর গদা ধরি করে। মহিষে মৃত্যুর নাথে, লোকান্তক দণ্ডহাত, চলিল সহিত সহচরে।। নিজ নিজ যানরোহ, চলিল যতেক গ্রহ, অষ্টবসু অশ্বিনীকুমার। পবন ধনুক ধরি, মৃগে আরোহণ করি, ইন্দ্র সহ কৈল আগুসার।। চড়িয়া মকরধ্বজ, চলিল জলের রাজ, পাশ অস্ত্র শোভে সব্য করে। শিখি পৃষ্টে আরোহণ, শক্তিকরে ষড়ানন, চলিল খাণ্ডব রাখিবারে। এইমত গুটি গুটি, দেবতা তেত্রিশ কোটি, গেল বন রক্ষার কারণে। আইল গরুড়পক্ষী, সঙ্গে লক্ষ লক্ষ পক্ষী, রক্ষাহেতু নিজ জ্ঞাতিগণে।। চিত্তে বহু অনুরাগ, আইল অনন্ত নাগ, কোটি কোটি ভুজঙ্গ সংহতি। আইল তক্ষক সেনা, ধরে শত শত ফণা, বিষবৃষ্টি পূর্ণ কৈল ক্ষিতি।। যক্ষ রক্ষ ভূত দানা, সহ নিজ নিজ সেনা, নানা অস্ত্রে শেল শূল লৈয়া। এমত লিখিব কত, ত্রিভুবনে আছে যত, বহে সবে আকাশ যুড়িয়া।। তবে দেব পুরন্দরে, আজ্ঞা দিল জলধরে, বৃষ্টি করি নিবার অনল। আজ্ঞামাত্র অতি বেগে, সম্বর্ত্তাদি চারিমেঘে, মুষল ধারায় ঢালে জল।। প্রলয় কালের বৃষ্টি, যেন মজাইতে সৃষ্টি, শিলা-জলে ছাইল আকাশ। মহাঘোর ডাক ছাড়ে, ঝন্ঝনা ঘন পড়ে, তিন লোকে লাগিল তরাস।। দেখি পার্থ মহাবল, না পড়িতে বৃষ্টিজল, শোষক বায়ব্য অস্ত্র এড়ে। শূন্যে অস্ত্র উঠে রোষে, শোষকে সলিল শোষে, বায়ব্যে সকল মেঘ উড়ে।। মেঘ হৈল পরাজয়, অতি ক্রোধে দেবরায়, বজ্র হানে শ্রীকৃষ্ণ অর্জ্জুনে। জানি নর-নারায়ণে, বজ্র না চলিল রণে, বাহুড়ি আইল ইন্দ্রস্থানে।। তবে ক্রোধে দেবরাজ, অস্ত্র ব্যর্থ পায় লাজ, উপাড়িয়া আনিল মন্দর। হুহুঙ্কারশব্দ ছাড়ে, যেন স্বর্গ ছিঁড়ি পড়ে, আইসে মন্দর গিরিবর।। ইন্দ্রপুত্র দিব্য শিক্ষা, ভরদ্বাজ-পুত্র দীক্ষা, অজেয় গাণ্ডীব ধরৈ ধনু। ক্ষিপ্রহস্তে এড়ে বাণ, গিরি করে খানখান, চূর্ণ করে যেন ক্ষুদ্র রেণু।। পর্ব্বত ফেলিল ছেদি, চমকিত জম্ভভেদী, নানা অস্ত্র করে বরিষণ। অনেক করিছে রণ, নিবারিতে হুতাশন, কে করিবে তাহার গণন।। বায়ু অগ্নি ভিন্দিপাল, ইন্দ্রজাল ব্রহ্মজাল, পরশু মুদগার শেল শূল। চক্রবাণ জাঠা জাঠি, নানা অস্ত্র কোটি কোটি, অর্দ্ধচন্দ্র তোমর ত্রিশূল।। তবল সাবল শাঙ্গী, ক্ষুরপা বেণব টাঙ্গি, কুঠার পট্টিশ বহুতর। ভল্ল শেল শব্দভেদী, কুন্ত খড়্গ রিপুচ্ছেদী, সূচীমুখ খট্টাঙ্গ বিস্তর।। যেন বৃষ্টি ঘোর বনে, ইন্দ্র ফেলে অস্ত্রগণে, সব নিবারেণ ধনঞ্জয়। অগ্নিতে পতঙ্গ পড়ে, যেন ভস্ম হৈয়ে উড়ে, ক্ষণমাত্রে হৈল সব ক্ষয়।। অগ্নি রাখে নারায়ণ, পার্থ করে মহারণ, সুরাসুর সবারে নিবারে। দেখি অর্জ্জুনের কাজ, সবিস্ময় দেবরাজ, সুরাসুর আগু নহে ডরে।। দেখি দেব ভঙ্গিয়ান, ক্রোধে হৈল আগুয়ান, গর্জ্জিয়া গরুড় মহাবীর। বজ্র সম দন্ত নখে, চলিল বিস্তার মুখে, গিলিবারে পার্থের শরীর।। আকাশে গরুড় পাখী, আইসে তখন দেখি, দিব্য অস্ত্র এড়ে ধনঞ্জয়। ব্রহ্মশির নামে বাণ, পূর্ব্বে কৈল গুরু দান, সকল হইল অগ্নিময়।। গর্জ্জে ব্রহ্মশির-অস্ত্র, গরুড় হইল ব্যস্ত, পলাইল শ্রেষ্ঠ বিহঙ্গম। নিজ পরিবার সঙ্গ, গরুড় দিলেক ভঙ্গ, ক্রোধে ধায় যত ভুজঙ্গম।। বিস্তারি সহস্র ফণ, শ্বাস বহে সমীরণ, গর্জ্জনে শ্রবণে লাগে তালা। বক্রমুখ দশ শত, বিষ বর্ষে অবিরত, যেন শ্রাবণের মেঘমালা।। ফাল্গুনি জানিল ফণী, গাণ্ডীব ধনুক টানি, পিপীলিকা নামে বাণ এড়ে। নানাবর্ণ নানারূপে, পিপীলিকা একচাপে, সকল ভুজঙ্গে গিয়া বেড়ে।। শিখী নামে দিব্য শর, এড়ে পার্থ ধনুর্দ্ধর, লক্ষ লক্ষ হইল ময়ূর। উড়িয়া আকাশ দিকে, খণ্ড খণ্ড করি নাগে, রক্তমাংস বরিষে প্রচুর।। নারিল সহিতে রণ, পাছু হৈল ফণীগণ, আগু হৈল যক্ষের ঈশ্বর। কোটি কোটি যক্ষ সাথে, ভয়ঙ্কর গদা হাতে, টঙ্কারিয়া নিল ধনুঃশর।। ঘন সিংহনাদ ছাড়ে, নানাবর্ণ অস্ত্র এড়ে, মুহূর্ত্তেকে হৈল অন্ধকার। না দেখি দিবসপতি, যেন অমাবস্যা-রাতি, শরজালে ঢাকিল সংসার।। যে অস্ত্রে যে অস্ত্র বারে, যথোচিত পার্থ মারে, দৃষ্টিমাত্রে করিল সংহার। অস্ত্র ব্যর্থ দেখি কোপে, দশনে অধর চাপে, গদা লয়ে ধায়ধনেশ্বর।। পার্থ এড়ে বজ্রশর, বাজিল হৃদয়োপর, খসিয়া পড়িল গদাবর। চিন্তিয়া আপন মনে, বিমুখ হইল রণে, রণ ত্যজি চলিল সত্বর।। সংগ্রামে পাইয়া লাজ, বাহুড়িল যক্ষরাজ, নিজ পরিবারের সংহতি। এইমতে ধনঞ্জয়, সমরে পাইয়া জয়, দেবতার করেন দুর্গতি।। এইমত ক্রমে ক্রমে, অরুণ বরুণ যমে, সবে আসি করিল সংগ্রাম। সত্য আদি চারিযুগে, নহিল না হবে আগে, সুরে নরে যুদ্ধ অনুপাম।। যুদ্ধে হৈল পরিশ্রম, চূর্ণ হৈল পরাক্রম, যক্ষগণ হইল বিমুখ। বহু জ্ঞাতিগণ বধে, আইল পরম ক্রোধে, নির্ব্বাণ করিতে হুতভূক।। রাক্ষস দানব দানা, ভূত প্রেত অগণনা, অপ্সরী কিন্নরী বিদ্যাধর। মুখেতে উলকা জ্বলে, মহারোল কোলাহলে, পিশাচর সৈন্য ভয়ঙ্কর।। বিবিধ আয়ুধ ধরে, ভয়ঙ্কর গদা করে, কেহ লয়ে পর্ব্বত পাষাণ। মার মার করি ডাকে, বৃক্ষ ধরি লাখে লাখে, ধায় কেহ বিস্তারি বয়ান।। দেখি দানবের সৈন্য, বাজাইয়া পাঞ্চজন্য, সুদর্শন এড়েন মুরারি। তেজে চক্র শত চণ্ড, ক্ষণমাত্রে লণ্ডভণ্ড, করেন দানবগণ মারি।। রাক্ষস পিশাচচয়, বাণে কাটি ধনঞ্জয়, কৈল বীর অগ্নির তর্পণ। লিখিবারে পারি কত, সংগ্রামে পড়িল যত, ভঙ্গ দিল, ছিল যত জন।। এইমত পুনঃ পুনঃ সুরাসুর নাগগণ, সংগ্রাম করিল অবিরাম। হেনকালে বন মাঝ, তক্ষক পন্নগরাজ, তার সুত অশ্বসেন নাম।। সখা করি হরিহয়ে, খাণ্ডব তক্ষকালয়ে, থাকে সহ নিজ পরিজন। গৃহে রাখি ভার্য্যাপুত্রে, গিয়াছিল কুরুক্ষেত্রে, সেইকালে কদ্রুর নন্দন।। আচম্বিতে বন দহে, বেড়িলেক হব্যবাহে, মাতা পুত্রে গণিল প্রমাদ। উপায় না দেখি কিছু, কোলেতে করিয়া শিশু, ফণিপ্রিয়া করয়ে বিষাদ।। অনলে নাহিক ত্রাণ, নাহি রক্ষা পাবে প্রাণ, অগ্নিতে ফেলাবে শর হানি। হৃদয়ে ভাবিয়া দুখ, চাহিয়া পুত্রের মুখ, কান্দি কহে তক্ষক-গৃহিনী।। উপায় না দেখি আর, খাণ্ডবাগ্নি হতে পার, শুন পুত্র আমার বচন। প্রবেশহ মোর পেটে, যদিহ আমারে কাটে, তুমি যাহ লইয়া জীবন।। মাতার বচন ধরে, উদরে প্রবেশ করে, বায়ুভরে উড়িল নাগিনী। অন্তরীক্ষে যায় উড়ে, পার্থের সম্মুখে পড়ে, দুই অস্ত্র এড়িল ফাল্গুনি।। এক অস্ত্রে কাটে মুণ্ড, পুচ্ছ কাটি তিনখণ্ড, নাগিণী পড়িল ভূমিতলে। অশ্বসেন উড়ি যায়, পার্থ না দেখিতে পায়, ইন্দ্র মোহ কৈল মায়াজালে।। দেখি পার্থ মহাক্রুদ্ধ, পুনঃ ইন্দ্র সহ যুদ্ধ, শরজালে ছাইল মেদিনী। ইন্দ্রার্জ্জুনে মহারণ, চমকিত ত্রিভুবন, আচম্বিতে হৈল শূণ্যবাণী।। না কর না কর দ্বন্দ্ব, কেন হৈল মতিধন্ধ, সংবর সংবর দেবরাজ। এই নর-নারায়ণে, সংগ্রাম করিয়া জিনে, নাহি হেন ব্রহ্মাণ্ডের মাঝ।। কোন্ প্রয়োজন হেতু, যুদ্ধ কর শতক্রুতু, অপমান পরিশ্রম সার। যেই হেতু চিত্তে আছে, কুরুক্ষেত্রে আগু গেছে, তব সখা কশ্যপ-কুমার।। শূন্যবাণী শনি ইন্দ্র, সহ যত সুরবৃন্দ, সমরেতে হইল বিরত। স্বর্গে গেল সুরপতি, নাগগণ ভোগবতী, যথাস্থানে গেল আর যত।। নিষ্কণ্টকে হুতাশন, দহয়ে খাণ্ডব বন, নানাবর্ণ পশুগণ পোড়ে। ভক্ষ্য ভক্ষক এক ঠাঁই, কেহ কারে চাহে নাই, ভয়ে বিপরীত ডাক ছাড়ে।। কুঞ্জর কেশরী কোলে, মৃগব্যাঘ্র এক স্থলে, মূষিক মার্জ্জার সহ বৈসে। একত্র মণ্ডুক নাগে, সঞ্চান না চায় বকে, দৃষ্টি নাই শার্দ্দূল মহিষে।। প্রলয় অনল তাপে, ভ্রমে সদা লাফে লাফে, উঠেছ ব্ড় বৃক্ষের উপরে। ভল্লুক নকুল যত, শিবাগণ শত শত, প্রবেশয়ে বিবর ভিতরে।। জলেতে যতেক বসে, অগাধ সলিলে পশে, খেচর আকাশে উড়ি যায়। কোথাও নাহিক ত্রাণ, হুতাশন লয় প্রাণ, কৃষ্ণার্জ্জুন কাটেন সবায়।। হেনকালে ময় নামে, আছিল তক্ষক ধামে, নমুচি দানব সহোদর। ভয়ে পলাইয়া যায়, পাছে খেদি অগ্নি ধায়, যেই ভিতে দেব দামোদর।। দানব দেখিয়া হরি, দেবতাগণের অরি, সুদর্শন ছাড়িলেন তায়। পাছে ধায় হুতাশন, মহাচক্র সুদর্শন, দানব-ঈশ্বরে, গিয়া পায়।। কাতরে ডাকয়ে ময়, রক্ষা কর ধনঞ্জয়, ত্রৈলোক্য-বিজয়ী কুন্তীসুত। বেড়িলেক মহাচক্র, ক্ষুদ্র মীনে যেন নক্র, পাছে অগ্নি যেন যমদূত।। শব্দ শুনি ধনঞ্জয়, ডাকি বলে নাহি ভয়, ভীম হয়ে ডাকে কোন্ জন। অর্জ্জুন অভয় দিল, সুদর্শন বাহুড়িল, অভয় দিলেন হুতাশন।। দানব পাইল রক্ষা, বন দহে সর্ব্বভক্ষ্যা, সকল করিল ভস্মময়। মনোভীষ্ট করি ভোগ, খণ্ডিল অগ্নির রোগ, সঙ্কল্পে তরিল ধনঞ্জয়।। বিশাল খাণ্ডব বন, নানাবর্ণে বৃক্ষগণ, নানা জাতি আছিল ওষধি। পশু পক্ষী নাগ যত, লিখন করিব কত, রাক্ষস দানব যক্ষ আদি।। যতেক খাণ্ডববাসী, পুড়ি হৈল ভ্স্মরাশি, কেবল রহিল ছয় জন। আদিপর্ব্ব ব্যাসকৃত, পাঁচালী প্রবন্ধে গীত, কাশীদাস দেব বিরচন।। ১৪৩. মন্দপাল ঋষির উপাখ্যান জন্মেজয় বলে মুনি কহ বিবরণ। অগ্নিতে পাইল রক্ষা কোন্ ছয় জন।। শুনিলাম ভুজঙ্গ দানব বিবরণ। অগ্নিতে বাঁচিল কেবা আর চারি জন।। মুনি বলে, শুন রাজা কথা পুরাতন। মন্দপাল নামে এক ছিল তপোধন।। ধার্ম্মিক তপস্বী জিতেন্দ্রিয় মহাধীর। তপ করি সদাকাল ত্যজিল শরীর।। তপঃক্লেশ ফলে দ্বিজ গেল স্বর্গবাস। স্বর্গে বসি সর্ব্ব সুখে হইল নিরাশ।। আর যত স্বর্গবাসী নানা সুখে সুখী। স্বর্গেতে থাকিয়া দ্বিজ চিত্তে বড় দুঃখী।। দুঃখচিত্তে দ্বিজ জিজ্ঞাসিল পুণ্যজনে। স্বর্গে মম দুঃখ দূর নহে কি কারণে।। কোন্ কর্ম্ম আমি না করিলাম ক্ষিতিতলে। কি হেতু স্বর্গেতে মম সুখ নাহি মিলে।। দেবগণ বলে, পুণ্যভূমি ভূমণ্ডল। সেথা যাহা করে, স্বর্গে ভুঞ্জে সেই ফল।। ভূমিতে জন্মিয়া কর্ম্ম বহুল করিলা। তাই আজি তুমি স্বর্গবাসী যে হইলা।। কিন্তু মর্ত্ত্যে পুত্রোৎপতি যে জন না করে। পুণ্যনাশে অন্তে যায় নরক ভিতরে।। বহু পুণ্যকর্ম্ম করে বহু করে দান। নরকে প্রবেশে যদি নহে পুত্রবান।। স্বর্গবাসে দুঃখ তুমি পাও সে কারণ। অন্য পাপ নাহি ইথে, শুন তপোধন।। এত শুনি মন্দপাল চিন্তিল অন্তরে। স্বর্গবাসে দুঃখ মম না সহে শরীরে।। পুনঃ গিয়া জন্ম লব পৃথিবী ভিতর। পুত্র জন্মাইয়া স্বর্গে আসিব সত্বর।। কোন্ জীব হৈলে হবে ঝটিতে সন্তান। পক্ষী জাতি হৈব বলি চিন্তে মতিমান।। ততক্ষণ দেবদেহ ত্যজি দ্বিজবর। পক্ষী গর্ভ প্রাপ্ত হৈল সংসার ভিতর।। শারঙ্গের মূর্ত্তি ধরি শারঙ্গী উদরে। চারিপুত্র মন্দপাল উৎপাদন করে।। কতদিনে খাণ্ডবেতে লাগিল দহন। ধ্যানেতে জানিল মন্দপাল তপোধন।। চারি পুত্র শিশু তারা, পক্ষ নাহি উঠে। হেনকালে অগ্নিমধ্যে ঠেকিল সঙ্কটে।। অগ্নিতে তরিতে শিশু না দেখি উপায়। পুত্ররক্ষা হেতু মুনি ধ্যানেতে ধেয়ায়।। সঙ্কল্প করিল আজি শ্রীকৃষ্ণ-পাণ্ডবে। এক জীব না রাখিবে এই ত খাণ্ডবে।। অগ্নি যদি রাখে, তবে জীয়ে পুত্রগণ। এত ভাবি করে দ্বিজ অগ্নিরে স্তবন।। তুমি ধাতা, তুমি ইন্দ্র, তুমি বৃহস্পতি। সকল দেবের মুখ্য সর্ব্বদেব স্থিতি।। চরাচরে যত বৈসে তোমাতে বিদিত। হব্য কব্য যত কিছু ত্রিগুণ ব্যাপিত।। তুমি ক্রুদ্ধ হৈলে কারো নাহিক নিস্তার। তিলমাত্রে ভস্ম কর সকল সংসার।। ব্রাহ্মণের ইষ্ট তুমি হও কৃপাবান। চারি গুটি পুত্রে মোর দেহ প্রাণদান।। দ্বিজ-স্তুতিবশে অগ্নি দিলেন অভয়। শুনি মন্দপাল হৈল সানন্দ হৃদয়।। খাণ্ডবে লাগিল অগ্নি মহাভয়ঙ্কর। শারঙ্গী পুত্রের সহ চিন্তিত অন্তর।। বালক অজাতপক্ষ এই চারি জন। কি উপায়ে পুত্র সবে করিব রক্ষণ।। সকরূণে বলে তবে চারি পুত্রগণে। এই গর্ত্তে প্রবেশ করহ এইক্ষণ।। প্রচণ্ড অনল উঠে পর্ব্বত আকার। আর কোন উপায়েতে না দেখি নিস্তার।। নাহিক এমন শক্তি আমার শরীরে। চারিজনে লয়ে আমি পলাই অচিরে।। অশক্ত অজাতপক্ষ তোরা চারি জন। গর্ত্তমধ্যে প্রবেশিয়া রাখহ জীবন।। শিশুগণ বলে গর্ত্তে প্রবেশি কেমনে। গর্ত্ত মধ্যে মূষা আছে বিকট বদনে।। শারঙ্গী বলিল, মূষা লইল সঞ্চানে। ক্ষণমাত্রে নিল এই মাত্র বিদ্যমানে।। পুত্রগণ বলে, গর্ত্তে বড়ই সংশয়। একে ঘোর অন্ধকার তাহে সর্পভয়।। অদৃশ্য স্থানেতে যাই মন নাহি সরে। কপালে আছয়ে যাহা, কে লঙ্ঘন করে।। বাহিরে থাকিলে যদি পুড়িব অনলে। সর্ব্বপাপে মুক্ত হৈব, শাস্ত্রে ইহা বলে।। কর্ম্ম-অনুসারে ফল ভুঞ্জিব এক্ষণ। তুমি অন্য স্থানে যাহ লইয়া জীবন।। অনেক মধুর বাক্য শারঙ্গী বলিল। তথাপি এ চারি শিশু গর্ত্তে নাহি গেল।। শিশু সব কহে, মাতা কেন কর দ্বন্দ্ব। তোমায় আমার মাতা কিসের সম্বন্ধ।। মায়ামোহে পড়ি কেন হারাও জীবন। আপনি থাকিলে কত পাইবে নন্দন।। নিজ শক্তি থাকিতে মরহ কেন পুড়ি। আইসে অনল দেখ শীঘ্র যাহ উড়ি।। অনল হইতে যদি পাই প্রতিকার। তোমার সহিত দেখা হবে পুনর্ব্বার।। পুত্রের বচন শুনি শারঙ্গী উড়িল। কানন দহিয়া তবে পাবক আইল।। প্রচণ্ড অনল, তাতে মহাবায়ু বহে। পর্ব্বত আকার জীবজন্তুগণ দহে।। দেখিয়া কাতর সবে মুনির নন্দন। জরিতরি নামে জ্যেষ্ঠ সারিসৃক্ক, দ্রোণ।। স্তম্ভমিত্র নামে চারি মুনির নন্দন। অগ্নি প্রতি যোড়করে করে নিবেদন।। আকুল হইয়া চারি জনে করে স্তুতি। বালক অজাত পক্ষ মোরা চারি জন। উপায় না দেখি কিছু রাখিতে জীবন।। সঙ্কটে ছাড়িয়া চলি গেল মাতা তাত। তুমি কৃপা কর প্রভু দেখিয়া অনাথ।। অনেক করিল স্তুতি শিশু চারি জন। তুষ্ট হৈয়া বলিলেন দেব হুতাশন।। না করিহ ভয় মন্দপালের তনয়। পূর্ব্বে তোমাদের আমি দিয়াছি অভয়।। আমা হৈতে ভয় না করিহ চারি জন। যে বর মাগহ দিব করিলাম পণ।। শিশুগণ বলে যদি হৈলা কৃপাবান। মনোমত বর দেহ, মাগি তব স্থান।। এখানেতে আছয়ে মার্জ্জার দুষ্টগণ। আমাদের গ্রাসিবারে আসে অনুক্ষণ।। সে সকল ভস্ম যদি কর দয়াময়। তবেত আমরা সবে হইব নির্ভয়।। সহাস্যে কহেন তবে দেব হুতাশন। নির্ভয়ে করহ সবে জীবন যাপন।। এত বলি সর্ব্বভুক শিশু চারিজনে। প্রাণ রাখি দহে বন ব্রহ্মার বচনে।। কৃষ্ণার্জ্জুন-বিক্রমে বিমুখ দেবগণ। নিবারিতে না পারিল খাণ্ডব দাহন।। আশ্চর্য্য মানিয়া তবে দেব পুরন্দর। দেবগণ সঙ্গে লৈয়া গগন উপর।। কহিলেন কৃষ্ণ আর অর্জ্জুনে ডাকিয়া। তোমরা উভয়ে আজ একত্র মিলিয়া।। যে কর্ম্ম করিলা তাহা অদ্ভুত কথন। দেবের দুষ্কর ইহা, ছার নরগণ।। তোমাদের পরাক্রম করি দরশন। হইলাম সাতিশয় আনন্দিত মন।। এই হেতু এক বাক্য বলি যে এখন। মনোনীত বর মাগ, তোমা দুই জন।। অর্জ্জুন বলেন, বর দিবে সুরেশ্বর। দিব্য অস্ত্র তূণ তবে দেহ পুরন্দর।। ইন্দ্র বলে, দিব অস্ত্র কত দিন গেলে। শিবে তুষ্ট যখন করিবে তপোবলে।। শ্রীকৃষ্ণ বলেন, বর মাগি যে তোমায়। অর্জ্জুনের সনে যেন বিচ্ছেদ না হয়।। হৃষ্ট হয়ে বর দিয়া গেল পুরন্দর। কৃষ্ণার্জ্জুনে বিদায় করিল বৈশ্বানর।। বর দিয়া নিজস্থানে গেল হুতাশন। হৃষ্ট হয়ে মম সহ যান কৃষ্ণার্জ্জুন।। ব্যাস বিরচিত এই ভারত সুন্দর। কাশী কহে, শ্রবণে পাপহীন হয় নর।। ১৪৪. সুভন্দ্রার সহিত অর্জ্জুনের ইন্দ্রপ্রস্থে গমন ও পঞ্চ পাণ্ডবের পুত্রোৎপত্তি অনন্তর অর্জ্জুন প্রভাসতীর্থে গিয়া। দ্বাদশ বৎসর শেষ তথায় বঞ্চিয়া।। তবে পুনঃ কতদিন রহি দ্বারাবতী। ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরিলেন সুভদ্রা সংহতি।। যুধিষ্ঠির-চরণে করেন প্রণিপাত। ধর্ম্ম আশীর্ব্বাদ দেন শিরে দিয়া হাত।। কুন্তী ভীমে প্রণমেন পার্থ সবিনয়ে। আশীর্ব্বাদ দেন দুই মাদ্রীর তনয়ে।। দ্রৌপদীকে সম্ভাষিতে অন্তঃপুরে যান। পার্থে হেরিয়া কৃষ্ণার জাগে অভিমান।। অধোমুখে রহিলেন অতি ক্রোধমন। কতক্ষণ থাকি পার্থ বলেন বচন।। কহ প্রিয়ে কি হেতু হও অভিমানিনী। কেন না সম্ভাষ মোরে পাঞ্চাল নন্দিনী।। দ্বাদশ বৎসর অন্তে হইল মিলন। ইহাতে অপ্রিয় হেন না বুঝি কারণ।। দ্রৌপদী বলিল, পার্থ নিদয় শরীর। হেথা হৈতে গেলে মোর চিত্ত নহে স্থির।। মোর স্থানে তোমার কি আর প্রয়োজন। যথায় যাদবী তথা করহ গমন।। শুনিয়া কহেন পার্থ হইয়া লজ্জিত। তুমি হেন কহ দেরি না হয় উচিত।। তোমা বিনা অর্জ্জুনের কে আছে সংসারে। লক্ষ স্ত্রী হলেও তুমি সবার উপরে।। আমরা যে পঞ্চ ভাই সকলি তোমার। ভদ্রা হেতু কর ক্রোধ না বুঝি বিচার।। শুনিয়া দ্রৌপদী মনে হইলা উল্লাস। প্রিয়বাক্য দুই জনে হইল সম্ভাষ।। আইলেন কত দিনে রাম-নারায়ণ। নানারত্ন সঙ্গেতে অনেক দাসীগণ।। অশ্ব হস্তী ধেনু বৃষ বিবিধ যৌতুক। কৃষ্ণে দেখি ধর্ম্মরাজ পরম কৌতুক।। আলিঙ্গন শিরোঘ্রাণ লৈয়া দুইজনে। অন্যান্যে সম্ভাষা করিলেন প্রীতমনে।। কতদিন পরে তবে পাণ্ডবের প্রীতে। বলভদ্র যান কৃষ্ণ রহেন তথাতে।। তবে কতদিনে ভদ্রা হৈল গর্ভবতী। পরম সুন্দর পুত্র প্রসবিল সতী।। দ্বিতীয় চন্দ্রের জ্যোতি অঙ্গের বরণ। রূপেতে করিলে আলো সকল ভুবন।। রূপেতে বীর্য্যেতে হৈল জনক-সমান। দ্বিজগণ নাম দিল করি অনুমান।। অভিবন মনোহর সুন্দর শরীর। মন্যুমান ক্রোধপর অতিশয় বীর।। সে কারণ অভিমন্যু দিল তার নাম। পশ্চাৎ কহিব যত তার গুণগ্রাম।। দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র পঞ্চজন হৈতে। সবাই সমান হৈল রূপেতে গুণেতে।। অনুমান করি নাম দিল দ্বিজগণ। প্রতিবিন্ধ্য নাম হৈল ধর্ম্মের নন্দন।। সুতসোম নাম বৃকোদর-সুত হৈল। শ্রুতকর্ম্মা বলি নাম পার্থ সুতে দিল।। শতানীক নাম হৈল নকুল-নন্দন। সহদেবসুত নাম হৈল শ্রুতসেন।। এই পঞ্চ নাম ধরে পঞ্চের সন্তান। রূপ গুণ বল বীর্য্যে জনক সমান।। পাণ্ডবের বংশবৃদ্ধি হইল এমত। দেখি সবে পুত্রমুখ হৈল আনন্দিত।। ভারত শ্রবণে কিছু না থাকে আপদ। দুঃখ শোক দূর হয় বাড়য়ে সম্পদ।। কাশীরাম দাস কহে, শুন সারোদ্ধার। ইহা বিনা সংসারেতে সুখ নাহি আর।। সুধাময় ভারত শ্রীব্যাসদেব রচিল। এতদূরে আদিপর্ব্ব সমাপ্ত হইল।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon